ধর্ম ডেস্ক: ইতেকাফ মাহে রমজানের বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ইবাদত। কদরের রাত হাসিল করার অন্যতম উপায়। ইতেকাফের মাধ্যমে মানুষ দুনিয়ার সবকিছু ছেড়ে আক্ষরিক অর্থে আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে যায়। রমজানের শেষ দশক তথা বিশ রমজান সূর্যাস্তের আগ থেকে ঈদের চাঁদ তথা শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখা পর্যন্ত ইতেকাফ করা সুন্নতে মুআক্কাদা আলাল কিফায়া। শরিয়তের হুকুম মোতাবেক কোনো মহল্লায় কয়েকজন বা কোনো একজন আদায় করলে সবাই দায়মুক্ত হয়ে যাবে। আর কেউ না করলে সবাই সুন্নত ছেড়ে দেওয়ার ধমকির শিকার হবে। তবে আদায়ের ক্ষেত্রে যে বা যারা আদায় করবে, শুধু সে বা তারাই সওয়াবের অধিকারী হবে।
‘ইতেকাফ’ আরবি শব্দ। অর্থ—অবস্থান করা, আবদ্ধ থাকা বা আবদ্ধ রাখা। শরিয়তের পরিভাষায় ইতেকাফ বলা হয়, ইবাদতের উদ্দেশে ইতেকাফের নিয়তে নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট জায়গায় অবস্থান করা। আর ব্যক্তিজীবনে এ ত্যাগ-তিতীক্ষার মহৎ উদ্দেশ্য হলো, লাইলাতুল কদর সন্ধান করা। হাজার রাতের সেরা রাত প্রাপ্তির মাধ্যমে মহান আল্লাহর একান্ত সান্নিধ্য লাভ করা। ইতেকাফের মাধ্যমে শবে কদর তালাশ করেছেন রাসুল (সা.)। তিনি বলেন, ‘এই (কদর) রজনী খোঁজার জন্য আমি প্রথম দশকে ইতেকাফ করেছি। এরপর মাঝের দশকে ইতেকাফ করেছি। তারপর মাঝ দশক পেরিয়ে এলাম। আমাকে বলা হলো, (কদর) তো শেষ দশকে। তোমাদের মধ্যে যদি কেউ তাকওয়া অর্জন করতে চায়, সে যেন ইতেকাফ করে।’ (মুসলিম : ১১৬৭)।
আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.) বলেন, ‘আল্লাহর প্রতি মন নিবিষ্ট করা, তাঁর সঙ্গে নির্জনে বাস করা এবং স্রষ্টার উদ্দেশে সৃষ্টি থেকে দূরে অবস্থান করা; যাতে করে তার চিন্তা ও ভালোবাসা মনে স্থান করে নিতে পারে, সেটাই প্রকৃত ইতেকাফ।’ আল্লামা হাফেজ ইবনে রজব (রহ.) বলেন, ‘ইতেকাফের উদ্দেশ্য হলো, সৃষ্টির সঙ্গে সাময়িকভাবে সম্পর্ক ছিন্ন করে স্রষ্টার সঙ্গে সম্পর্ক কায়েম করা। আল্লাহর সঙ্গে পরিচয় যত দৃঢ় হবে, সম্পর্ক ও ভালোবাসা তত গভীর হবে। তা বান্দাকে আল্লাহর কাছে নিয়ে যাবে।’
ইতেকাফের আদেশ কোনো মানুষের পক্ষ থেকে নয়, বরং এটি স্বয়ং আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার প্রতি বিশেষ নির্দেশ। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমি ইবরাহিম ও ইসমাইলকে আদেশ করলাম, তোমরা আমার গৃহকে তওয়াফকারী, ইতেকাফকারী ও রুকু-সেজদাকারীদের জন্য পবিত্র রাখো।’ (সুরা বাকারা : ১২৫)। কোরআনুল কারিমের বর্ণনার পর অসংখ্য হাদিসেও রাসুল (সা.)-এর ইতেকাফ পালন সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘ইন্তেকাল পর্যন্ত রাসুল (সা.) রমজানের শেষ দশকে ইতেকাফ করেছেন। এরপর তার স্ত্রীগণ ইতেকাফ করেছেন।’ (বোখারি : ১৮৬৮)।
ইতেকাফ একটি স্বচ্ছ ও নিখুঁত ইবাদত। তাই ইতেকাফরত অবস্থায় এমন সব কথা ও কাজ না করা, যাতে কোনো গোনাহ হয়। তবে প্রয়োজনীয় সাংসারিক কথাবার্তা বলতে নিষেধ নেই। অহেতুক অযথা বেহুদা অনর্থক কথাবার্তা দ্বারা পুণ্য নষ্ট হয়। ইতেকাফের মাধ্যমে একমাত্র আল্লাহর জন্য নিজেকে আবদ্ধ করে নেওয়া চাই। মুসলমানের অন্তরের কঠোরতা দূর করা জরুরি। দুনিয়ার প্রতি ভালোবাসার প্রাচীর ছেদ করা চাই। যাতে আত্মিক উন্নতির প্রাপ্তি অনুভূত হয়। এ নিগূঢ় সম্পর্ক দীর্ঘ সময় মসজিদে অবস্থানের কারণে হাসিল হয়। ফলে বান্দার অন্তর মসজিদের সঙ্গে জুড়ে যায়। আত্মার প্রশান্তি লাভ হয়। মসজিদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার অভ্যাস গড়ে ওঠে। হাদিস অনুযায়ী যে সাত ব্যক্তিকে আল্লাহতায়ালা আরশের ছায়ার নিচে স্থান দেবেন, তাদের একজন হলেন ওই ব্যক্তি, মসজিদের সঙ্গে যার হৃদয় ছিল বাঁধা।’ (বোখারি : ৬২০)।
পুরুষদের ইতেকাফ মসজিদে, নারীদের নির্দিষ্ট ঘরে বা নির্ধারিত কক্ষে। প্রাকৃতিক প্রয়োজন ও একান্ত প্রয়োজন ছাড়া ওই ঘর বা কক্ষ থেকে বের হওয়া নিষেধ । অজু-ইস্তিঞ্জা বা পাক-পবিত্রতার জন্য বাইরে বেরুতে পারবে। তবে কারও সঙ্গে কথাবার্তা বলবে না। প্রয়োজনে ভেতর থেকে বাইরের কাউকে ডাকতে পারবে। কেউ ভেতরে এলে তার সঙ্গে কথাবার্তা বলতে পারবে। একই কক্ষে বা একই বিছানায় অন্য যে কেউ অবস্থান করাতে ক্ষতি নেই। এমনকি স্বামীও পাশে থাকতে পারবে। তবে স্বামী-স্ত্রীসুলভ আচরণ ইতেকাফ অবস্থায় নিষিদ্ধ। এর দ্বারা ইতেকাফ নষ্ট হয়ে যাবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা স্ত্রীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ো না, যখন তোমরা ইতেকাফরত থাকবে।’ (সুরা বাকারা : ১৮৭)।
ইতেকাফের ফজিলত সম্পর্কে নতুন করে বর্ণনা করার তেমন কিছু নেই। কোরআন ও হাদিসে বর্ণিত ইতেকাফের গুরুত্ব অপরিসীম। যুগের পর যুগ পাড়ি দিয়ে আজ অবধি চলছে ইতেকাফের মহিমান্বিত ইবাদত। হাদিসে ইতেকাফের অনেক ফজিলত উল্লিখিত হয়েছে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয়ই ফেরেশতারা তোমাদের একজনের জন্য দোয়া করতে থাকেন, যতক্ষণ সে কথা না বলে, নামাজের স্থানে অবস্থান করে। তারা বলতে থাকে, আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিন, আল্লাহ তার প্রতি দয়া করুন, যতক্ষণ তোমাদের কেউ নামাজের স্থানে থাকবে এবং নামাজ তাকে আটকে রাখবে, তার পরিবারের কাছে যেতে নামাজ ছাড়া আর কিছু বিরত রাখবে না, ফেরেশতারা তার জন্য এভাবে দোয়া করতে থাকবে।’ (মুসলিম : ৬০১১)।
মানবজীবনকে সোনার অক্ষরে সাজাতে হলে ইচ্ছাশক্তি প্রবল করা এবং প্রবৃত্তিকে খারাপ অভ্যাস থেকে বিরত রাখার অভ্যাস গড়ে তোলা চাই। আর তা হতে পারে ইতেকাফের মতো পুণ্যময় ইবাদতের মাধ্যমে। ইতেকাফ এ ক্ষেত্রে সুবর্ণ সুযোগ করে দেয়। ইতেকাফ ধৈর্যের গুণে গুণান্বিত হতে শেখায়। ইতেকাফ থেকে একজন মানুষ সম্পূর্ণ নতুন মানুষ হয়ে বেরিয়ে আসার সুযোগ পায়। যা পরকালে উপকারে আসবে। এ ছাড়া ইতেকাফের মাধ্যমে অন্তরে প্রশান্তি আসে। বেশি বেশি কোরআন তেলাওয়াতের সুযোগ হয়। ঐকান্তিকভাবে তওবা করার ফুরসত হয়। তাহাজ্জুদে অভ্যস্ত হওয়া যায়। সময়কে সুন্দরভাবে কাজে লাগানো যায়। আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় হয়। আল্লাহর দিকে আকৃষ্ট হওয়ায় অন্তর সংশোধিত হয়। ঈমানি দৃঢ়তা অর্জনের পথ লাভ হয়। আল্লাহতায়ালা বিশুদ্ধ নিয়তে ইতেকাফ পালন করার তৌফিক দান করুন। আমিন।
লেখক : কবি, গীতিকার ও প্রাবন্ধিক